অর্ণব পণ্ডা

মণীন্দ্র গুপ্ত, যোগিয়া বাড়ি ও দেবারতিদি

১১ জানুয়ারি ২০২৪ এর সকাল পেরিয়ে বেলা দশটার দিকে সমাজমাধ্যমে জানতে পারলাম,অন্ধ স্কুলে আর ঘন্টা বাজবে না।আমি তখন স্টেটবাসের মধ্যে, কর্মস্থলের দিকে রওনা হয়েছি।বসেছি জানলার ধারে।বাইরে তাকালাম।কাচের জানলার ভেতর দিয়ে চলমান জীবন চোখে পড়ল।এর আগে যে কোনোদিন দেখিনি তা নয়।তবে আজ একজন কবির মৃত্যুর পরে এই চলমান জীবন ,তার ছন্দ আমার চোখে অন্যভাবে ধরা দিল।অথচ এই কবি,দেবারতি মিত্রের লেখায় তো বহির্জগতের ঘাত প্রতিঘাত  ঢুকে পড়েনি সেভাবে।বরাবরই অন্তর্মুখী।লাবণ্য ও বিষাদে মেশা সম্পর্কের খুঁটিনাটি নিয়ে জীবনের গভীর জটিল স্তর ফুটে থাকে তাঁর কবিতায়।তবে কবির মৃত্যুর পর এই ছুটন্ত বাস-ট্যাক্সি মোটরবাইক, গতিময় চাকার দৃশ্য কেন বেজে উঠল চোখে?কেন না,প্রায় পনের বছর আগেকার এক বিস্ময়মাখানো প্রশ্ন মনে পড়ে গেল আমার।প্রথম সাক্ষাতের দিন যা তিনি বলেছিলেন আমাকে,এত দূর থেকে বাস ট্রেন যানবাহন পেরিয়ে কীভাবে এলে তুমি?আর এত দূর ফিরবেই বা কীভাবে?রাত হয়ে যাবে?ভাবলেই তো আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে!মণীন্দ্রবাবু অবশ্য স্বাভাবিক নিস্পৃহ ভঙ্গিতে বলেছিলেন,ও …ওরা এখনকার ছেলে।দূরত্ব আবার কী!ও ঠিক পৌঁছে যাবে।

একথা স্বীকার করে নেওয়া ভালো যে সেই লেখা শুরুর দিনগুলোতে যোগিয়া বাড়িতে আমরা কবি মণীন্দ্র গুপ্তের কাছেই লেখা দেখাতে যেতামকিন্তু মণীন্দ্রবাবুর পাশে সারাক্ষণই ছায়ার মতো দেবারতিদি থাকতেনসহজ অনাড়ম্বর আতিথেয়তার মধ্যেই তিনি টুকটাক ঘরের কাজ সারতেনকিন্তু তাঁর কান পড়ে থাকত কবিতার শব্দের দিকেকখনো কিছুক্ষণ বসতেনও সেখানেএকবার একটি শব্দ নিয়ে দুজনের বিপরীত মতও দেখতে পেলামদেবারতিদি বলছেন,কবিতার প্রয়োজনে শব্দটি রাখা যেতে পারেকিন্তু মণীন্দ্রবাবু বলছেন,প্রয়োজন আবার কী!একজন কবিতালেখক নতুন শব্দ ব্যবহারের চেষ্টা করতে পারেতবে এই তর্ক বেশিক্ষণ স্থায়ী হতো নাদেবারতিদি কিছুক্ষণ পরেই হয়তো বলতেন,তোমাদের মণীন্দ্রবাবু যা বলছেন ভেবে দেখতে পারোউনি কিন্তু কবিতার শিক্ষক

ঘরে ঢুকেই বাঁদিকের দেওয়ালে বইঠাসা তাকআমি দেখতাম মণীন্দ্রবাবু মাঝে মাঝে উঠে গিয়ে বইগুলোতে হাত বোলাতেনদেবারতিদি হয়তো বলতেন,কিছু খুঁজছ? মণীন্দ্রবাবু বরাবরই নিস্পৃহভাবে বলতেন,নাতারপর আবার এসে বসতেন চেয়ারেএকবার যোগিয়াবাড়িতে পৌঁচেছিমণীন্দ্রবাবু চেয়ারে হেলান দিয়ে গান শুনছেনআমি যেতে বললেন,বোসোগান শেষ হওয়ার পর টেপরেকর্ডার বন্ধ করলেনওপাশ থেকে দেবারতিদি এসে বসলেন খাটেগান বন্ধ হয়ে গেছেকিন্তু তার সুর তখনো ছায়া বিছিয়ে আছে আমাদের মনেপ্রায় পাঁচ মিনিট চুপচাপ থাকবার পর দেবারতিদি বললেন,খেয়ে বেরিয়েছ তো?আসতে কোনো অসুবিধে হয়নি?আমি ঘাড় নাড়িকিন্তু সেই গানের রেশ ছুঁয়ে রয়েছে আমার মনযেন কুয়াশাহেমন্তের শুরুতে নতুন হিম পড়ার সময় যা লেগে থাকে গাছে গাছেশেষে বোকার মতো জিজ্ঞাসা করে বসলাম,এটা কী গান বাজছিল?মণীন্দ্রবাবুই উত্তর দিলেন,মীরার ভজনলতা মুঙ্গেশকরের গাওয়া

নতুন কেউ যোগিয়া বাড়িতে এলে মণীন্দ্রবাবু দেবারতিদি চঞ্চল বালক বালিকার মতো হয়ে উঠতেনকত ধরনের প্রশ্ন করতেন তার ঠিক নেইবাড়ির বাইরে নিজেরা বেরোতে পারেন না বলে বাইরের কেউ এলে তাকে ঘিরেই তাদের ভ্রমণ সম্পন্ন হয়ে উঠতোআচ্ছা অর্ণব,বাড়িতে কে কে আছেন?তোমাদের বাড়ির আশেপাশে কি কি গাছপালা আছে?বাড়ি কবে তৈরি করেছ?তোমাদের ফুলের গাছ আছে?বেলফুল?তাহলে তো সন্ধেবেলা সুগন্ধে ভরে যায় চারপাশএইসব প্রশ্নের মধ্যেই একদিন মণীন্দ্রবাবু আচমকা বলে বসলেন,তুমি বিয়ে করেছ?আমি না, এই প্রস্তুতি চলছে, বলবার সঙ্গে সঙ্গেই দেবারতিদি বলে উঠলেন,বিয়ের পর বউকে নিয়ে আসবে কিন্তুআমি হেসে উঠতেই মণীন্দ্রবাবু সতর্ক করেন,হাসি নয়নিয়ে আসবেপরে বউকে নিয়ে যাওয়া হয়নি অবশ্যকিন্তু বিয়ে করেছি শুনে দেবারতিদি,কি দিই,কি উপহার দিই বলতে বলতেই কোথা থেকে একটা সিনথল সাবান বের করে আনলেনহাতে দিয়ে বললেন,এটা দিলাম ওকে

‘রৌদ্রছায়া’র শেষ সংখ্যা মণীন্দ্রবাবুর হাতে তুলে দিয়েছিউল্টেপাল্টে দেখছেন তিনিলেটার প্রেসে ছাপো?এখনো আছে ওখানে?কথাগুলো বলবার সময় লক্ষ করলাম একটা উত্তেজনা তৈরি হচ্ছে তাঁর মুখেবলছেন,পত্রিকা করলে এরকমই করোআমি আড়চোখে মণীন্দ্রবাবুর মধ্যে জেদি সম্পাদকের ছায়া লক্ষ করছিলামহয়তো ওনার ‘পরমা’পত্রিকার কথা মনে পড়ছিল

যোগিয়া বাড়িতে গেলে বাৎসল্য কী জিনিস তা সহজেই টের পাওয়া যেততরুণ কবিরা যেন তাঁদেরই সন্তান এইরকম মনে হতো খুবঅনেকদিন আগে একটি লেখায় বলেওছিলাম সেকথাআটপৌরে হাসিখুশি সহজ সরল দেবারতিদিকে একদিনই হঠাৎ খুব চুপচাপ থমথমে হয়ে উঠতে দেখেছিলামতখন আমার ‘বিভাবকবিতা’ বেরিয়ে গেছে‘কাঁচাবাঁশের গন্ধ’বইটির পাণ্ডুলিপি তৈরি হয়েছেএকদিন শোনাতে গেছিবিকেলে গিয়ে পৌঁচেছিজানলার দিকে বসলামকয়েকটি কবিতা পড়লামমাকে নিয়ে একটি কবিতা পড়লাম তারপরদেবারতিদি থম মেরে বসে রইলেনধীরে ধীরে বললেন,অর্ণব ,তোমার কবিতা শুনে আমার মায়ের কথা মনে পড়ে গেলদেখো কবিতায় শব্দের কী শক্তি!কয়েকটা শব্দ এক লহমায় গোটা ঘরের পরিবেশ,মনের অবস্থা বদলে দিল একেবারেমণীন্দ্রবাবু গম্ভীরভাবে শুধু বললেন,হুমকিছুক্ষণ চুপ থাকার পর আমার কবিতা নিয়ে সেইদিনই বললেন কিছু কথাসেসব এখানে উল্লেখ করা ঠিক নয়আর একটা কথা বললেন যেটা শুনে আমি চমকে উঠেছিলামবলেছিলেন,তোমার বাসস্থান কখনো পরিবর্তন করো নাওই পরিবেশ তোমার লেখার পক্ষে উপযুক্ত

প্রথম যেদিন যোগিয়া বাড়ি গিয়েছিলাম,মেদিনীপুর থেকে আসছি শুনে তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন করেছিলেন,বীতশোকের সঙ্গে আলাপ আছে?…ওর সঙ্গে যোগাযোগ রেখোখুবই পাওয়ারফুল কবিদেবারতিদি কথাবার্তার ফাঁকে কখন প্লেটভরতি বিস্কুট আর সন্দেশ নিয়ে নিজের হাতে চা করে আনলেনমণীন্দ্রবাবু সেদিন নলেন গুড়ের একটা কড়াপাক সন্দেশ হাতে নিয়ে তৃপ্তি করে খাচ্ছিলেনকেন জানি না এই দৃশ্যটি আমার মনে রয়ে গেছে

ফিরে আসবার সময় মণীন্দ্রবাবু আর দেবারতিদি সিড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিলেনমণীন্দ্রবাবু,দেখলাম,ওপর থেকে সিড়ির দিকে নীচে তাকিয়ে আছেনআমি একবার ওপরে তাকাতেই বললেন,সাবধানে যেওআবার আসবে

যোগিয়া বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটু হেঁটে গড়িয়া ডিপো থেকে হাওড়াগামী বাস ধরেছিলামআজকের মতোই স্টেটবাসের জানলায় চোখ রেখে বিকেলের কথা মনে করে শিহরিত হচ্ছিলামদীপাবলি আর  দু-এক দিনের মধ্যেইশহর আলোয় সেজে উঠছিলসেই আলোয় ভেসে ভেসে আমি বাড়ি ফিরে আসছিলাম…

আজ এতদূর থেকে সেই লেখাশুরুর দিনগুলোকে দেখতে পাচ্ছি আবারকোনো পরিচিতি নেইআমি ব্যাগে খাতা ভরে কতদিন বাসন্তীতলা,যোগিয়াবাড়ি, নন্দীবাগান ঘুরে বেড়িয়েছিনীচু হয়ে বসেছি,কীভাবে কবিতা লেখা যায়শুধু কবিতা তো নয়, শেখা দরকার জীবনযাপনওসেই মন আর কখনো পাব না আমিক্রমাগত মানুষ,যানবাহন,সভাসমিতি,উৎসব পেরোতে পেরোতে ,লেখা ছাপাতে ছাপাতে আমি সেই মন হারিয়ে ফেলেছি,দেবারতিদি!

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment